সোমবার ০২ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দক্ষিণ বগুড়ার আতঙ্ক সাগর বাহিনী
প্রকাশ: বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৫:৩৬ অপরাহ্ণ

মাত্র এক যুগ আগেও ছিলেন ট্রাকের হেলপার। এরই মধ্যে বনে যান মাদক সম্রাট। মাদক বিক্রি করে এক ঘণ্টায় যে আয় হয়, এক মাসের পরিশ্রমের বেতনের চেয়ে তা অনেক বেশি। টাকার এ আকর্ষণ চৌম্বক গতিতে অন্ধকার জগতে টানে সাগরকে। তিনজন থেকে শুরু করে গড়ে তোলেন ৫০ জনের সন্ত্রাসী বাহিনী। মানুষের হাত কেটে নেওয়া, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি যাদের নিত্যদিনের রুটিন। দক্ষিণ বগুড়ার মূর্তিমান এই আতঙ্কের নাম সাগর বাহিনী।

বগুড়ার দুই উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের ৫০টি গ্রামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন এই বাহিনীর প্রধান সাগর তালুকদার। সর্বশেষ কলেজ শিক্ষক ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শাহজালাল তালুকদার পারভেজকে খুন করে এখন আবার এসেছেন আলোচনায়। তবে চতুরতা অবলম্বন করে হত্যার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন তদারকি করেন কারাগারে বসেই।

অনুসন্ধান বলছে, বগুড়ার শীর্ষ সন্ত্রাসী সাগর তালুকদার বড় কোনো অপরাধ করার আগে স্বেচ্ছায় জেলে যান। জেলে বসে তার বাহিনী দিয়ে এসব অপরাধ বাস্তবায়ন করেন। খুনের পর তার বিরুদ্ধে মামলা হলে ওই সময় কারাগারে ছিলেন এমন তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে সহজেই সে মামলায় জামিন পান। এভাবে চারটি খুনের মধ্যে দুটি খুনের সময় তার অবস্থান জেলেই ছিল। তবে জেলে থাকলেও আসামির তালিকা থেকে সাগরের নাম বাদ পড়েনি। তিনি সরকারি দলের অঙ্গসংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী হয়েও স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজ দলের নেতাকর্মীদের খুন করতেও দ্বিধা করেন না। সাগরের ভয়ে এলাকা ছেড়েছেন অনেকে। সাগরের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে এলাকায় নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলে মিলেছে এসব তথ্য।

শাজাহানপুর উপজেলার আশেকপুর ইউনিয়নের সাবরুল গ্রামের গোলাম তালুকদারের ছেলে সাগর। ট্রাকের হেলপারি ছেড়ে ২০১০ সাল থেকে মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন। এরপর প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিরোধ শুরু হয়। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ২০১০ সালে স্থানীয় কলমা গ্রামের সুলতান নামে একজনের ডান হাতের কবজি কেটে নেন তিনি। এই কবজি কাটার মধ্যে দিয়েই সাগরের রক্তের হোলিখেলা শুরু। চলতে থাকে একের পর এক চাঁদাবাজি, মারামারি, অপহরণ ও খুনের ঘটনা। এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে ২০১৭ সালে প্রতিপক্ষ মজনু মিয়া নামে একজনকে খুন করেন। ২০২০ সালের ৫ জুন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আবু হানিফ মিস্টারকে খুন করেন। এই খুনটিও ছিল আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। ২০২১ সালের ৩০ মে আরেক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সিহাব উদ্দিন বাবুকে সাবরুল বাজারে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুন করেন। তবে বাবু খুনের সময় সাগর জেলে ছিলেন। কারাগারে যাওয়ার আগে বাবুকে খুনের পরিকল্পনা এবং জেলে বসে তা বাস্তবায়ন করান তিনি। এরপর বিভিন্ন সময় তার নানা অপকর্ম চলে। তবে সর্বশেষ শিকার হন আশেকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কলেজ শিক্ষক শাহজালাল তালুকদার পারভেজ। গত ২ সেপ্টেম্বর সাবরুল বাজার থেকে মোটরসাইকেলে বগুড়া শহরে যাওয়ার পথে মাথাইলচাপর এলাকায় তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই খুনের পরিকল্পনা করা হয় এক মাস আগে। পরিকল্পনা মতো ১৯ দিন আগে ১৩ আগস্ট সাগর অস্ত্র আইনের একটি মামলায় আদালতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে জেলে যান। জেলে বসেই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করান তার কিলার বাহিনী দিয়ে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাবরুল এলাকায় মাথাইলচাপর গ্রামের টিপু সুলতান নামে এক স্বেচ্ছাসেবক লীগ কর্মী এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মাদকের কারবার ও চাঁদাবাজি করতেন। টিপুর ছিল ১৫ সদস্যের একটি বাহিনী। টিপুর প্রতিপক্ষ গ্রুপ ছিল সাগরের। টিপু বনাম সাগর গ্রুপের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। একপর্যায়ে সাগর বাহিনীর কাছে টিপু বাহিনী হার মানতে বাধ্য হয়। টিপু বাহিনীর অনেকেই সাগর বাহিনীতে যোগ দেন। টিপু এখন তার কয়েকজন অনুসারী নিয়ে এলাকা ছেড়ে বগুড়া শহরে বসবাস করছেন।

রানীরহাট-দুর্গাপুর আঞ্চলিক সড়কের পাশে সাবরুল বাজার। এই বাজারে রয়েছে সাগরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মামা-ভাগনে এন্টারপ্রাইজ। এখান থেকে বিভিন্ন নির্মাণকাজে জোর করে ইট, বালু, মাটি, সিমেন্ট ও রড সরবরাহ করেন সাগর। তার বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে মাদক কারবারের পাশাপাশি চাঁদা আদায়ের টার্গেট ব্যক্তি শনাক্ত করেন। এরপর সাগর ফোন করে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা দাবি করেন। না দিলে অপহরণ করে এনে টাকা আদায় করা হয়।

গ্রামের বাসিন্দারা জানান, শাজাহানপুর উপজেলার সাবরুল, হিন্দুপাড়া, নন্দকুল, পদ্মগাড়ি, আশেকপুর, মাথইলচাপর, চাংগুইর, বৈঠাপাড়া এবং কাহালু উপজেলার রঘুনাথপুর, ওলাহালি ডোমরগ্রাম, বিশা বড়গাছা, ভালসুন, পানিসারা, ভেটিসোনাই, অঘোর মলঞ্চা, ঢাকন্তা, গুড়বিশা ও শিবাকলমা গ্রাসসহ ৫০টি গ্রামের লোকজন সাগর বাহিনীর কাছে জিম্মি। কাহালুর মালঞ্চা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নেছার উদ্দিন দাবি করেন, তার ইউনিয়নের আট গ্রামের মানুষ সাগরের কাছে জিম্মি।

এছাড়া বিভিন্ন সময় সাগরের হাতে অত্যাচারিতদের মধ্যে শাবরুল বাজারে কাপড় ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম সাগরের অব্যাহত চাঁদাবাজির কারণে ব্যবসা গুটিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। শফিকুল ইসলাম নামে এক ট্রাকচালককে এলাকা ছাড়া করেছেন চাঁদা না দেওয়ায়। ছোট হিন্দুপাড়া গ্রামের পরিমলের ছেলে নাপিত সুমন তিন লাখ টাকা দিতে না পারায় অপহরণের শিকার হন। এরপর গরু, স্বর্ণালঙ্কার এবং জমি বিক্রি করে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন পরিমল। সন্ত্রাসীরা সেই সময় আরও এক লাখ টাকা দাবি করে হুমকি দিয়েছিল টাকা না দিলে সুমনকে হত্যা করা হবে। এরপর সুমন তার স্ত্রী এবং চার বছরের সন্তানকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান।

সাগরের বিরুদ্ধে ১৯ মামলা
সাগরের বিরুদ্ধে কাহালু ও শাজাহানপুর থানায় আগের মামলা ছিল ১৮টি। কলেজশিক্ষক পারভেজ হত্যার পর আরও একটি মামলা যোগ হয়। সেগুলোর মধ্যে চারটি হত্যা মামলা। অন্যগুলো মাদক, চাঁদাবাজি, মারধর, অস্ত্র আইনে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ২০১০ সাল থেকে গত ১৩ বছরে সাগর বহুবার জেলে গেছেন। বারবার জামিনে বের হয়ে আসার কারণে তার ভয়ে মুখ খোলার সাহস পান না কেউ।

আশেকপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হযরত আলী বলেন, সাগরের অপরাধ কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় তাকে ধাওয়াও করেছিল। কিন্তু তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান।

কাহালুর মালঞ্চা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মতিউর রহমান বলেন, আমার এলাকায় দুই মাস আগে এক যুবকের পুকুর দখল করে সাগর। বাধা দেওয়ায় ওই যুবককে ছুরিকাঘাত করে সাগর বাহিনীর ক্যাডাররা।

শিক্ষক পারভেজ হত্যার নেপথ্যে
পারভেজের বড় ভাই নুরুজ্জামান তালুকদার পানু সাবরুল বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ছিলেন। ওই বাজারে সাগর চাঁদাবাজি করতে গেলে সভাপতি হিসেবে পানু বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন।

এছাড়া বাবু হত্যা মামলার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন পানু। এ নিয়ে পানুর ওপর চরম ক্ষোভ ছিল সাগরের। পানুকে দেড় মাস আগে রাস্তা থেকে তুলে আস্তানায় নিয়ে ছুরিকাঘাত করেন সাগর। ওইদিনই পারভেজকে খুন করার হুমকি দিয়েছিলেন সাগর।

অন্য একটি সূত্র জানায়, দুই মাস আগে পারভেজ এক কোটি ২০ লাখ টাকায় সাবরুল বাজার এলাকায় তিন তলার একটি বাড়ি কেনেন। এই বাড়িটি মিলন নামে এক ফিডমিল ব্যবসায়ী বিক্রি করেন। বাজার মূল্যের চেয়ে কমে মাত্র ৫০ লাখ টাকায় সাগর সেই বাড়ি কিনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গোপনে বাড়িটি পারভেজ কেনেন। পরে জানতে পেরে সাগর পারভেজের কাছে ২০ লাখ টাকা চাঁদি দাবি করেন। এই চাঁদা না দেওয়ার জেরে ক্ষোভ থেকে পারভেজকে খুন করা হয়। পারভেজকে খুন করার আগেরদিনও সাগর জেল থেকে মোবাইল ফোনে তার বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেন। হত্যার একঘণ্টা আগেও ২ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টা ১৩ মিনিটে সর্বশেষ কথা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলের ভেতর থেকে ব্যবহৃত ওই নম্বরটি জেলাখানার নয়। এটি ব্যক্তিগত নম্বর এবং বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার চাঁপাপুর ইউনিয়নের কাঞ্চনপুর গ্রামের এক ব্যক্তির নামে রেজিস্ট্রেশন করা। তবে বগুড়া কারাগারের জেলার ফরিদুর রহমান বলেন, কয়েদি-হাজতিরা প্রতি সপ্তাহে প্রয়োজন মতো সরকারি ফোনে জেল সুপারের অনুমতি নিয়ে কথা বলতে পারেন। এখানে বাইরের নম্বর বা ফোন ব্যবহারের সুযোগ নেই।

যা বলছে পুলিশ
শাজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহীদুল ইসলাম বলেন, সাগরের বিরুদ্ধে মামলার প্রায় সবগুলোতেই তিনি জামিনে আছেন। সর্বশেষ শিক্ষক পারভেজ হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। সাগর জেলে থাকায় ওই মামলায় তাকে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। তবে তার বাহিনীর সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। পারভেজ হত্যা মামলায় সাগরের বোন রোকসানা আক্তার ও চাচা উজ্জ্বল হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নিহত পারভেজের স্ত্রী শামসুন নাহার বাদী হয়ে সাতজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন।

শাজাহানপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি জিয়াউল হক জুয়েল বলেন, সাগর আমাদের সংগঠনের কেউ নয়। সে নিজেকে দলের কর্মী দাবি করলেই হবে না। আমরাও শিক্ষক পারভেজসহ সব হত্যার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি। এছাড়া শাজাহানপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ পৃথক বিবৃতিতে পারভেজ হত্যার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে।

 







সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত

এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ