নোট-গাইডে ঝুঁকছেন শিক্ষকরাই
|
নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠদান ও মূল্যায়ন বুঝতে শিক্ষার্থীরা নয়, এবার শিক্ষকরাই নোট-গাইডের দিকে ঝুঁকছেন। দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষকরা পাঠদানপ্রক্রিয়া নিয়ে নোট তৈরি করে অনেক শিক্ষককে তা সরবরাহ করছেন। অন্যদিকে নতুন পাঠ্যক্রমের ষষ্ট ও সপ্তম শ্রেণির বিভিন্ন বইয়ের অনুশীলন বই বাজার থেকে সংগ্রহ করে শিক্ষকরা সহায়তা নিচ্ছেন। আগামী বছর অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই দেওয়া হবে। এই পরিস্থিতিতে অনেক শিক্ষক বাজারের অনুশীলন বই বা ‘নোট-গাইডে’ আগ্রহী হয়ে উঠবেন। শিক্ষক সহায়িকায় (টিজি) সংক্ষিপ্তভাবে থাকায় শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন নিশ্চিত করা এবং কীভাবে মূল্যয়ন করা হবে, তা বুঝে উঠতে পারছেন না অনেক শিক্ষক। তবে শিক্ষার্থীরা সহজেই পাঠ্যবই বুঝতে পারছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দিতে পারলে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন দুরূহ হয়ে পড়বে। পাঠ্যবইয়ের পাঠ শিক্ষার্থীদের কাছে সহজ হলেও শিখনফল অর্জন নির্ভর করবে শিক্ষকদের ওপর। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না হওয়া পর্যাপ্ত শিক্ষকরা নোট-গাইডের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া বিকল্প থাকবে না। পাঠ্যবেইয়ের নির্দিষ্ট পাঠ শিক্ষার্থীকে কীভাবে পাড়াবেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। এরই মধ্যে তিন মাস পার হয়ে গেছে। এ ছাড়া আগামী শিক্ষাবর্ষে নতুন শিক্ষাক্রমের অষ্টম ও নবম শ্রেণির পাঠ্যবই দেওয়া হবে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনফল অর্জন নিশ্চিত করতে পাঠদান বুঝে নিতে শিক্ষক সহায়িকা সরবরাহ করা হয়েছে পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে। তবে মূল্যায়ন কীভাবে হবে, তার বিস্তারিত কোনও নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। গত ১৩ মার্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর মূল্যায়ন বিষয়ে আঞ্চলিক পরিচালকদের একটি নির্দেশনা দিয়েছে। এতে বলা হয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিখন-শেখানো ও মূল্যায়ন কার্যক্রমের ক্ষেত্রে এনসিটিবি প্রণীত শিক্ষক সহায়িকা এবং শিক্ষাক্রমের নির্দেশনা অনুসারে সম্পাদন করতে হবে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রচলিত কোনও পরীক্ষা-মডেল টেস্ট গ্রহণ করা যাবে না। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের বিষয়ে এনসিটিবি থেকে যে গাইডলাইন পাওয়া যাবে, তা পরে জানিয়ে দেওয়া হবে। বলা হয়েছে, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান প্রধান, উপজেলা/থানা একাডেমিক সুপারভাইজার, উপজেলা/থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, জেলা শিক্ষা অফিসার, আঞ্চলিক উপপরিচালক এবং আঞ্চলিক পরিচালকদের নিয়মিত পরিবীক্ষণ জোরদার করতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেষ্ট ও সচেতন থাকতে হবে। এ বিষয়ে কোনও রকমের ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা দায়ী থাকবেন। এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, মাধ্যমিকের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের শিখনকালীন মূল্যায়ন ৬০ শতাংশ ও সামষ্টিক মূল্যায়ন (বছর শেষে পরীক্ষা) ৪০ শতাংশ। বাকি বিষয় জীবন ও জীবিকা, তথ্যপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি (বিদ্যমান বিষয়-চারু ও কারু কলা) শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ। আর নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের শিখনকালীন মূল্যায়ন ৫০ শতাংশ আর সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৫০ শতাংশ। নবম ও দশম শ্রেণির বাকি বিষয়গুলোর শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্ট শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে যে শিক্ষাক্রম তৈরি করা হলো, সেটা বাস্তবায়নে যদি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা না যায়, তাহলে তো হোঁচট খাবে। আগে থেকেই তো ঝুঁকিগুলো জানার কথা। প্রথম যে ঝুঁকি বা চ্যালেঞ্জ তা হচ্ছে শিক্ষকদের প্রস্তুত করা। শিক্ষকদের প্রস্তুতির জায়গাটা এখনও দুর্বল। তিনি বলেন, অবশ্য প্রশিক্ষণ ক্রমাগত দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষকরা কতখানি প্রশিক্ষণ নিতে পারছেন, সব শিক্ষকদের এক পাল্লায় নেওয়া যাবে না। অনেক শিক্ষক যোগ্যতা অর্জন করেছেন করছেন অনেক শিক্ষক হয়তো পারছেন না সেই পর্যায়ে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষকরা পাল্লা দিতে গিয়ে নিজেরাই নোট-গাইডের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। সেখানে আমাদের প্রত্যাশা ছিল শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক হবে। এই শিক্ষাবিদ বলেন, সব শিক্ষককেই প্রস্তুত করতে হবে, অন্তত বেশির ভাগ শিক্ষককে প্রস্তুত না কতে পারি, শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে কতখানি অনুশীলন করছেন, সেটা যদি নিয়মিত মনিটরিং না করতে পারি, মনিটরিংয়ের পর আবার যেখানে যেখানে সমস্যা আছে। সে জায়গায় সমাধান না করতে পারি তাহলে আমরা শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে অনেকখানি পিছিয়ে যাবো; ভালো একটা উদ্দেশে হোঁচট খাবে। প্রশিক্ষণ কতখানি নিতে পারছেন এবং প্র্যাকটিস করতে পারছেন, সেটা নিয়মিত দেখা জরুরি হয়ে গেছে। আমাদের শিক্ষক প্রশাসনকে প্রস্তুত করা জরুরি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের আগের যেসব শিক্ষক রয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। তবে এসব শিক্ষকরা আগামী ৫ বছরের মধ্যে প্রায় সব অবসরে যাবেন। তা ছাড়া উপজেলা পর্যায়ে ১১ বিষয়ের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষককে মাস্টার ট্রেইনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। মাস্টার ট্রেইনাররা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে সমস্যা থাকবে না। নোট-গাইড শিক্ষার্থীরা গ্রহণ করবে না, আগামী ৫ বছরের মধ্যে সব সমাধান হয়ে যাবে। স্বাধীনতা শিক্ষক কর্মচারী ফেডারেশনের প্রধান সমন্বয়কারী স্বাশিপ সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু বলেন, সব শিক্ষকের মেধা তো আর সমান নয়, তা ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রম সে কারণে নোট-গাইডে ঝুঁকতে পারেন। তবে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পেলে সে সমস্যা থাককে না। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বাশিস) সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি বলেন, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকায় দুর্বল শিক্ষকরা নোট-ডাইডের দিকে ঝুঁকছেন। এ ছাড়া তাদের বিকল্প নেই। দক্ষ শিক্ষকদের তৈরি করা নোট অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষকরা সংগ্রহ করছেন। অনেক শিক্ষক নোট বিক্রিও করছেন। বাজারের নোট-গাইড সংগ্রহ করছেন অনেক শিক্ষক। এ জন্য শিক্ষকরা দায়ী নন। কারণ যথাযথ প্রশিক্ষণ এখনও শিক্ষকরা পাননি। প্রশিক্ষণ সারা বছর চালাতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, সারা বছরই প্রশিক্ষণ অব্যাহত থাকবে। তিনি আরও বলেন, শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তর করা হচ্ছে, অথচ শিক্ষকের মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না, যথাযথ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
|