বাঘ জরিপ: ক্যামেরা ট্র্যাপিং শেষ
|
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার জরিপের কাজ চলছে। ইতোমধ্যেই সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জ এলাকায় ক্যামেরা ট্র্যাপিং কাজ শেষ হয়েছে। এখন ছয় মাস বিরতি থাকবে এ কাজে। আগামী ১ নভেম্বর থেকে বাগেরহাটের শরণখোলা রেঞ্জ এলাকা দিয়ে আবার শুরু হবে ক্যামেরা ট্র্যাপিং কাজ। টানা চার মাসের এ কাজ চাঁদপাই রেঞ্জ দিয়ে শেষ হবে। এরপর পর্যালোচনা করে ২০২৪ সালের ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবসে জরিপের তথ্য মাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসীন বলেন, ‘ইতোমধ্যেই সাতক্ষীরা রেঞ্জের ২০০টি ক্যামেরা প্রথম দফায় তোলা হয়েছে। এরপর খুলনা রেঞ্জে ১৪০টি ক্যামেরা বসানো হয়েছিল। সেগুলোও ৩০ এপ্রিল তোলা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জের জরিপের ক্যামেরা ট্র্যাপিং কাজ শেষ হলো। ঝড়-বৃষ্টির মৌসুমের কারণে ৬ মাস জরিপের ক্যামেরা বসানো হবে না। ১ নভেম্বর থেকে শরণখোলা রেঞ্জ দিয়ে আবার শুরু হবে। যা চাদপাই রেঞ্জে শেষ হবে ২০২৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। শরণখোলায় ১৮০ এবং চাদপাইতে ১৪৫টি ক্যামেরা বসানো হবে। আর পর্যালোচনা শেষে ২০২৪ সালের ২৯ জুলাই মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তথ্য প্রকাশ করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাঘ থাকলে সুন্দরবনের পরিবেশ স্বাভাবিক থাকবে। তাই বর্তমানে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ে বাঘ জরিপ চলছে। পাশাপাশি বাঘের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত প্রাণী হরিণ ও শুকরের সংখ্যা জানতেও পৃথক সার্ভে করা হচ্ছে।’ বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ছয় হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে বনভূমি চার হাজার ৮৩২ এবং জলাভূমি এক হাজার ১৮৫ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৯৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, এই বনভূমির স্থলে ২৮৯ প্রজাতির প্রাণীর বসবাস। এ ছাড়া ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী বাস করে। ২০১৫ সালের বাঘশুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘ ছিল ১০৬টি। আর ২০১৮ সালের শুমারিতে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪। বর্তমানে বাঘশুমারি চলছে। সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের অনেক বন্যপ্রাণীই এখন ভালো নেই। থেমে নেই বাঘ ও হরিণ শিকার। এ বছরও সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকা থেকে শিকার করা বাঘের চামড়াসহ গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালের ২০ আগস্ট বনের ছাপড়াখালি এলাকা থেকে বন বিভাগ একটি বাঘের মরদেহ উদ্ধার করে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ১০ থেকে ১২ বছর বয়সী বাঘটির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। একই কথা বলা হয় ফরেনসিক প্রতিবেদনেও। ২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বনের কবরখালি এলাকায় মেলে ১৪ বছর বয়সী আরেকটি বাঘের মরদেহ। ওই বাঘটিরও স্বাভাবিক মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে ময়নাতদন্তে। অথচ সুন্দরবনের বাঘ সাধারণত বেঁচে থাকে ১৮ থেকে ২০ বছর। ২০২১ সালের ১৯ মার্চ পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের ধনচেবাড়িয়ার চর থেকে একটি মৃত বাঘ উদ্ধার করে বন বিভাগ। এ ছাড়া ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি সুন্দরবন সংলগ্ন রাজৈর এলাকা থেকে পাচারকারীদের কবল থেকে একটি বাঘের চামড়া উদ্ধার করে র্যাব ও বন বিভাগ। বন বিভাগের ১৯৯৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সুন্দরবনের ৪৫০টি ছোট-বড় নদী ও খালে ১৫০ থেকে ২০০টি কুমির ছিল। ২০১৭ সালের সবশেষ সমীক্ষায় কুমিরের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ১৫০ থেকে ২০৫টি। ওই সমীক্ষায় কুমিরের জন্য সাতটি হুমকি চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে– জেলেদের জালে আটকা পড়ে কুমিরের বাচ্চার মৃত্যু; মধু আহরণ মৌসুমে মৌয়ালদের চলাফেরার কারণে ডিমে তা দিতে কুমিরের সমস্যা; বিষ দিয়ে মাছ ধরা; পশুর নদীতে নৌযান ও শিল্প-কারখানার বর্জ্যে দূষণ; পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া; গুইসাপ কুমিরের ডিম খেয়ে ফেলা এবং ছোট বাচ্চা খেয়ে ফেলে পুরুষ কুমির। বেসরকারি সংস্থা ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির জরিপ অনুযায়ী, ২০০৬ সালে সুন্দরবনের নদীগুলোতে ৪৫১টি ইরাবতি ডলফিন এবং ২২৫টি শুশুক ডলফিন ছিল। আর বন বিভাগের ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, ইরাবতি ডলফিন আছে ১১৩টি এবং শুশুক ডলফিন ১১৮টি। জেলেদের জালে আটকা পড়ে এবং নৌযানের প্রপেলারের আঘাতে মারা যাচ্ছে ডলফিন। এ ছাড়া ডলফিন পাচার, অতিরিক্ত মাছ আহরণ, পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি, বিষ দিয়ে মাছ ধরা, পানি দূষণের কারণেও ডলফিনের অস্তিত্ব নিয়ে হুমকি বেড়েছে। বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের হরিণ, বানর, শূকর, উদবিড়াল বা ভোঁদড়ের সবশেষ শুমারি হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। ওই শুমারির তথ্য অনুযায়ী, বনে হরিণ ছিল এক থেকে দেড় লাখ; বানর ৪০ থেকে ৫০ হাজার; শূকর ২০ থেকে ২৫ হাজার; উদবিড়াল ২০ থেকে ২৫ হাজার। এর পর আর এই চারটি বন্যপ্রাণীর কোনও শুমারি হয়নি। এ ছাড়া সুন্দরবনে রয়েছে গুইসাপ, অজগর, কচ্ছপ, পাখি, বনমোরগসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। কিন্তু কখনোই সেগুলোর কোনও শুমারি হয়নি। অধিকাংশ বন্যপ্রাণীর হালনাগাদ সংখ্যা জানা নেই বন বিভাগের। ইতোপূর্বে বন থেকে বিলুপ্ত হয়েছে বনমহিষ, মিঠা পানির কুমির, এক প্রজাতির হরিণ, চার প্রজাতির পাখি। জেলেদের জালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে ডলফিন, শুশুক, কুমিরের বাচ্চা ও বিরল প্রজাতির কচ্ছপ। জলবায়ু পরিবর্তনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মানুষের নানা অত্যাচারে কয়েক প্রজাতির প্রাণী এখন সংকটাপন্ন। বনের নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরার ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে মাছ ও কাঁকড়ার ওপর। বিলুপ্ত হতে চলেছে ১৯ প্রকার মাছ। এক সময় সুন্দরবনের করমজল, হাড়বাড়িয়া, কটকা, জামতলা, কচিখালি ও ডিমের চর এলাকায় নদীর দুই পাশে অসংখ্য হরিণ, বানর, শূকর, গুইসাপ ও পাখি দেখা যেত। আগের তুলনায় সেগুলো এখন কম দেখা যায়। প্রাণীর সংখ্যা কমে যাওয়া প্রসঙ্গে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী জানান, জলবায়ু পরিবর্তন ও মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় সুন্দরবনের নদীগুলোতে ক্রমাগত বাড়ছে লবণাক্ততা। এর ফলে সুন্দরবনের প্রাণীকূলের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কুমিরের প্রজনন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি পান করে রোগাক্রান্ত হচ্ছে বাঘসহ অন্যান্য প্রাণী। সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার জন্য খাদ্যশৃঙ্খলের কী অবস্থা এবং কোন প্রাণী কত সংখ্যক রয়েছে, তা জানা খুবই জরুরি। সে জন্য বন বিভাগকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর “স্মার্ট প্রেট্রোলিং” আর জেলে-বনজীবীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে ঠেকানো যাচ্ছে না বাঘ, হরিণ হত্যা। বন্ধ হচ্ছে না খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার।’
|