রবিবার ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৩১ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বৈষম্য আর কম মজুরির চাপে শ্রমিক
প্রকাশ: সোমবার, ০১ মে ২০২৩, ১১:৫৪ পূর্বাহ্ণ

দেশে বিভিন্ন অঞ্চলের নারী পোশাক শ্রমিকদের মজুরিতে পার্থক্য রয়েছে ৫১ থেকে ৬০ শতাংশ। নারীদের পাশাপাশি পুরুষদের মজুরিতেও রয়েছে বিস্তর ফারাক। সম্প্রতি ‘লিভিং ওয়েজ, লিভিং প্ল্যানেট: সেপ্টেম্বর ২০২২ আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। প্রতিবেদন সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, যে বেতন পোশাক শ্রমিকেরা পান, তা দিয়ে বর্তমান বাজারমূল্যে জীবনযাপন প্রায় অসম্ভব। তবে আশা কথা হলো—পোশাক শ্রমিকের বেতন পুনর্গঠনের জন্য বোর্ড গঠন করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, দ্রুততম সময়ে নতুন বেতন কাঠামো পাবেন তারা। শ্রমিক নেতারা বলছেন, পোশাক শ্রমিকের নির্ধারিত বেতন কাঠামো থাকলেও অন্যান্য সেক্টরের অধিকাংশ শ্রমিক অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে কাজ করায় বৈষম্য বেশি, বেতনও কম।

আজ মে দিবস। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। ১৮৮৬ সালের এই দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ওই দিন তাদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য শ্রমিকদের আত্মত্যাগের এই দিনটিকে তখন থেকেই সারা বিশ্বে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি’—এই স্লোগানে এ বছর শ্রমিকের অধিকার বুঝে নেওয়ার এ দিনটি পালিত হচ্ছে। তবে নানাবিধ বৈষম্যের মধ্যেই। পোশাক শিল্প, চাতাল, ইটভাটা, শুঁটকি মহাল— সব জায়গাতেই যে বেতন দেওয়া হয়, তা দিয়ে শ্রমিকের জীবনযাপন কঠিন হয়ে উঠেছে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা মাইক্রোফাইন্যান্স অপরচ্যুনিটিজ (এমএফও)-এর এক যৌথ সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৪ ভাগের ৩ ভাগই নারীকর্মী। অঞ্চলভেদে এসব কর্মীর মজুরির পার্থক্য ৯ হাজার ৪০৮ টাকা। নারী পোশাক শ্রমিকদের পাশাপাশি পুরুষদের মজুরিতেও পার্থক্য উঠে এসেছে। অঞ্চলভেদে পুরুষকর্মীদের মজুরির পার্থক্য ৭ হাজার ৯৪৭ থেকে ১৪ হাজার ৪০০ টাকা। তবে মানসম্মতভাবে জীবনধারণের জন্য এই বেতন পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন সানেমের গবেষকরা।

বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পোশাক শ্রমিকদের জীবনমানের ব্যয় মেটানোর জন্য ন্যূনতম মজুরির একটি কাঠামোও সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। সানেমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় জীবনযাপনের জন্য শ্রমিকদের মজুরি ১৯ হাজার ২০০ টাকা থেকে ২২ হাজার ৯০০ টাকা হওয়া দরকার।

দেশের রফতানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের মজুরি সমন্বয়ের জন্য নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করেছে সরকার। ৬ সদস্যের এই বোর্ডে একজন বোর্ড-প্রধান ও একজন স্বতন্ত্র প্রতিনিধি, কারখানার মালিক, শ্রমিক, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন এবং সরকারের একজন করে প্রতিনিধি আছেন।

বিজিএমইএ বলছে, এমনিতে ন্যূনতম ৫ শতাংশ করে বেতন বাড়ানো হয়। ওয়েজ বোর্ড গঠন হয়েছে এরইমধ্যে। একটু সময় লাগবে, কিন্তু নতুন ওয়েজ সরকার গঠন করবে। আমরা চাই বেতন বাড়ানো হোক। এমন একটা বেতন হোক— যাতে তাদের জীবন ধারণ সহজ হয়, মালিকেরও আয়ত্তে থাকে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা হয়ে যাবে।

বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বোর্ড গঠন হয়েছে। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে হয়তো প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হবে। বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের কাছ থেকে মতামত নেওয়া হবে। গার্মেন্টের প্রতি স্তরের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জীবনমানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বেতন ঘোষণা হবে। বাজার দর শ্রমিকদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। তবে মেশিনের শ্রমিক লেভেলে বেতন বৈষম্য খুব বেশি নেই। সুপারভাইজার পর্যায়ে থাকতে পারে।’

কাজের পরিমাণ ও মান পুরুষদের মতো বা ক্ষেত্রবিশেষে বেশি হলেও মজুরি বৈষম্য চরমে চাতালের নারী শ্রমিকদের। জানা গেছে, খাদ্য ও কৃষিসমৃদ্ধ অঞ্চল শেরপুর, দিনাজপুর, খুলনা ছোট-বড় যেকোনও চাতালে প্রায় ৮০ ভাগ নারী শ্রমিক থাকেন। চাতালগুলোতে শত শত নারী শ্রমিক কঠোর পরিশ্রম করলেও এখনও দিনে মাত্র ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা মজুরি পান। অথচ সমপরিমাণ শ্রম দিয়েও পুরুষরা ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা মজুরি পান। তাদের অভিযোগ—বছরে কয়েক মাস চাতাল বন্ধ থাকে, কাজহীন সময়ের সুরক্ষায় তাদের কিছু জমানোর সুযোগ নেই। যদিও মালিকদের দাবি, পুরুষরা তুলনামূলক ভারী কাজগুলো করে বলে তাদের মজুরি বেশি। খুলনার চাতালের বেগম ফাতেমা বলেন, ‘আমার অংশের কাজটা না করলে কি চলবে? ভারী হালকা কাজ আবার কী। আমরা এসব নিয়ে কথাও বলতে পারি না। কাজ থেকে বের করে দেবে। তাতে থাকার জায়গাটাও হারাবো। এই আয়ে বাইরে বাসা নিয়ে থাকা সম্ভব না।’

আব্দুল আজিজ জানান, কক্সবাজারের নাজিরারটেকে শুঁটকি মহালের ৪৩৫টি মাছখোলায় প্রায় ১২ হাজার নারী শ্রমিক কাজ করেন। শ্রমিকদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা ৬০ ভাগ। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে এখানে নারী শ্রমিকেরা পান ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, আর একজন পুরুষ পান ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এখানের এক পুরুষ শ্রমিক বলেন, আমাদের এখানে নারীদের বেশি সময় কাজ করানো হয়। তাদের কম বেতন দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া গেলে মালিকের লাভ। নারীরা কাজটা করেন অনেক সময় সংসারের সহযোগী হিসেবে। তারা কোনও কথার প্রতিবাদ করেন না। মালিক সেই সুযোগ নেন।

শ্রমিক নেতা শহীদুল ইসলাম মে দিবসে দাবি জানিয়ে বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। স্বাস্থ্যসম্পন্ন নিরাপদ কর্ম পরিবেশ পাওয়ার অধিকার সব শ্রমিকের আছে। আমরা চাই, একটা গণতান্ত্রিক শ্রম আইন হোক—যেখানে শ্রমিককে ভালোভাবে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার দেওয়া হবে।’







সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত

এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ