বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ৮ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাজধানীতে অপরাধ বেশি তেজগাঁওয়ে, কম রমনা বিভাগে
প্রকাশ: বুধবার, ১০ মে ২০২৩, ১২:৫৩ অপরাহ্ণ

রাজধানীতে খুন, অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, চুরি-ডাকাতি, অস্ত্র, মাদক, চোরাচালান, ধর্ষণ, নারী-শিশু নির্যাতন, সড়ক দুর্ঘটনাসহ অর্ধশত ধরনের অপরাধ সংগঠিত হয়। এসব অপরাধে বছরজুড়ে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ২০-৩০ হাজার মামলা হয়। প্রতি বছরই বাড়ছে মামলার সংখ্যা। গত বছর রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মাদক, চোরাচালান, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং চুরির ঘটনায়। আবার একেক এলাকায় একেক ধরনের অপরাধ বেশি হয়েছে।

২০২২ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মামলার উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ চিত্র দেখা গেছে। ডিএমপির তথ্যমতে, ২০২০ সালে ডিএমপির ৫০টি থানা মিলে মামলা হয়েছে ২২ হাজার ৬৭৩টি, ২০২১ সালে ২৭ হাজার ৪৬১টি ও ২০২২ সালে ২৮ হাজার ৭৪৯টি। গত বছর এসব মামলায় ৬১ হাজার ৪৯৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব মামলা নিষ্পত্তি ও অপরাধ দমন করতে গিয়ে ২০২২ সালে ৮৮ জন পুলিশ সদস্য হামলার শিকার হয়েছেন।

২০২২ সাল ও আগের কয়েক বছরের অপরাধচিত্র বিশ্লেষণ করে ডিএমপির কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীর কোনো এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি, কোনো এলাকায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বেশি। রাজধানীর যেসব এলাকায় নিম্ন আয় ও ভাসমান মানুষের বসবাস বেশি, সেখানে মাদক, চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের ঘটনাও বেশি ঘটে। এর বড় কারণ দারিদ্র্য ও অপরাধ প্রবণতা। আবার কোনো কোনো এলাকায় দেখা যায়, যৌতুক বা নানা কারণে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেশি। এসব অপরাধের ক্ষেত্রে দরিদ্রতা যেমন মুখ্য ভূমিকা পালন করে আবার অন্য এলাকায় কখনো কখনো অপরাধ প্রবণতা, ক্ষমতাসহ নানা কারণ রয়েছে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে।

রাজধানীর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ৫০টি থানাকে ৮টি অপরাধ বিভাগে ভাগ করে কাজ করে ডিএমপি। বিভাগগুলো হলো রমনা, লালবাগ, ওয়ারী, মতিঝিল, তেজগাঁও, মিরপুর, গুলশান ও উত্তরা।

২০২২ সালের অপরাধ ও মামলার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগে সবচেয়ে বেশি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। সবচেয়ে কম হয়েছে রমনা বিভাগে। তেজগাঁও বিভাগে ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি পাঁচ হাজার ৩৩৩টি মামলা হয়েছে আর রমনা বিভাগে সবচেয়ে কম দুই হাজার ৩০০টি মামলা হয়েছে।

গত বছর তেজগাঁও বিভাগের তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, মোহাম্মদপুর, আদাবর, শেরেবাংলা নগর ও হাতিরঝিল ছয়টি থানা মিলে সবচেয়ে বেশি দুই হাজার ৭৮৬টি অস্ত্র-মাদক-চোরাচালান মামলা হয়েছে। এছাড়া এ বিভাগে সবচেয়ে বেশি ৩৯টি দস্যুতা, ৩৩টি ছিনতাই এবং ৩৫৯টি চুরি, ১৪৬টি সিধেল চুরি, ১৩২টি জখম সংক্রান্ত, এক হাজার ৪৪৮টি অন্য ঘটনায় মামলা হয়েছে।

অপরাধ বেশি তেজগাঁওয়ে, কম রমনা বিভাগে
রমনা মডেল, ধানমন্ডি, শাহবাগ, নিউমার্কেট, হাজারীবাগ ও কলাবাগান থানা নিয়ে গঠিত রমনা বিভাগে অস্ত্র-মাদকে সবচেয়ে কম এক হাজার ৭৭টি মামলা হয়েছে। বিভাগটিতে সবচেয়ে কম ৯২টি নারী নির্যাতন, ২৫টি ধর্ষণ, দুটি ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে। তবে চোরাচালান, বিস্ফোরকদ্রব্য, চাঁদাবাজিসহ বেশ কিছু অপরাধে এখানে কোনো মামলা হয়নি।

পুলিশ বলছে, ভাসমান ও নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি থাকায় তারা নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। ছোট-বড় প্রতিটি অপরাধেই মামলা ও গ্রেফতার হচ্ছে। গ্রেফতারের পর এসব অপরাধী জামিনে বেরিয়ে ফের একই অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। ফলে একেক জনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হওয়ায় মামলার সংখ্যা কিছুটা বেশি।

তবে রমনা বিভাগে অপরাধ প্রবণতা কম হওয়ার বিষয়ে রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. শহীদুল্লাহ বলেন, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ ছোট ছোট যেসব অপরাধ রয়েছে সেগুলো যেন না হয় এজন্য আগে থেকেই নিয়মিত মোবাইল মনিটরিং করা হয়। পুলিশ সদস্যরা ছোট অপরাধগুলোতে একটু সচেতন থাকে। নারী-শিশু নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ যেন না হয় তার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে সচেতনতা তৈরি করা হয়। ফলে বেশির ভাগ মামলাই যেখানে এসব নিয়ে হয় তাই এগুলো নিয়ন্ত্রণ করলে মামলা অনেক কমে যায়।

খুন-অপহরণ বেশি ওয়ারী ও মিরপুরে
ডিএমপির ওয়ারী বিভাগে ওয়ারী, ডেমরা, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, গেন্ডারিয়া ও কদমতলী এ ছয়টি থানা। এখানে প্রায়ই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের ৩ এপ্রিল ও ১৩ মার্চ ডেমরা থানার আমুলিয়া মডেল টাউন এলাকায় দুটি খুনের ঘটনা ঘটে। নিহত দুজনই ছিলেন অটোচালক। গত বছর ডিএমপিতে ১৭৩টি খুনের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৭টি ঘটে ওয়ারী বিভাগে। ৩১টি মিরপুর বিভাগে। এছাড়া মতিঝিল ও গুলশানে ২১টি করে, লালবাগ ও উত্তরা বিভাগে ১৭টি করে খুনের ঘটনা ঘটেছে। আর রমনায় ১৬টি ও তেজগাঁওয়ে ১৩টি।

২০২১ সালেও সবচেয়ে বেশি ওয়ারী বিভাগে ৩৫টি, মিরপুর বিভাগে ২৬টি খুনের ঘটনা ঘটে। অপহরণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি দশটি মামলা হয়েছে মিরপুর বিভাগে। ওয়ারীতে সাতটি মামলা।

ওয়ারী বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. জিয়াউল আহসান তালুকদার বলেন, খুনের ঘটনায় ওয়ারী বিভাগে যেসব মামলা হয়েছে, এর অধিকাংশই অন্য জায়গায় খুন করে মরদেহ ওয়ারী বিভাগে ফেলে যাওয়ার ঘটনায়। হত্যার পর আলামত নষ্ট করতে অধিকাংশ অপরাধী মরদেহ নির্জন স্থান বা নদীতে ফেলে দেয়। ফলে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিবর্তন হয়েছে। কারণ প্রকৃত ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহগুলো অন্যত্র ভেসে যায় বা নির্জন স্থানে ফেলে যায় অপরাধীরা। ফলে ভিকটিমের নিখোঁজ ডায়েরি (জিডি) দেখা যায় অন্য এলাকার। এছাড়া বেশকিছু এলাকায় প্রচুর ভাসমান ও ছিন্নমূল মানুষ রয়েছে। তারাও অনেক সময় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।

ধর্ষণ ও নারী-শিশু নির্যাতন বেশি মতিঝিলে
ডিএমপির পল্টন, মতিঝিল, শাজাহানপুর, সবুজবাগ, রামপুরা, মুগদা ও খিলগাঁও এ সাতটি থানা নিয়ে গঠিত মতিঝিল বিভাগে নারী ও শিশু নির্যাতন সবচেয়ে বেশি ঘটেছে।

২০২২ সালে বিভাগটিতে ৪২২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনায় ৯৬টি ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ৯৭টি।

মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) হায়াতুল ইসলাম খান বলেন, যৌতুক, অপহরণ, ধর্ষণ— এ তিন কারণে মতিঝিল বিভাগে মামলা বেশি। সবুজবাগ, মুগদা, খিলগাঁও ও রামপুরা মতিঝিল বিভাগের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। পাশাপাশি এখানে নিম্নআয়ের মানুষের বসবাস বেশি। এসব এলাকায় যৌতুক বা পারিবারিক কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনাও বেশি। এছাড়া প্রেমের ঘটনায় অপহরণ বা পালিয়ে যাওয়ার ঘটনার পাশাপাশি বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের ঘটনায় মামলার সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনা বেশি ওয়ারী, মতিঝিল ও গুলশানে
ডিএমপির তথ্যমতে, ২০২২ সালে রাজধানীতে ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ওয়ারী বিভাগে ৬২টি এবং মতিঝিল ও গুলশান বিভাগে ৫৬টি করে মামলা হয়েছে।

পুলিশ বলছে, ওয়ারী ও মতিঝিল এলাকায় বেশি সংখ্যক গাড়ি বা যানবাহন চলাচল করে। এসব এলাকায় ভাসমান ও ছিন্নমূল মানুষের নিয়ম না মেনে রাস্তা পারাপার হওয়াসহ চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর ফলে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি। আর গুলশানে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার পেছনে অন্যতম কারণ হলো গভীর রাতে দামি গাড়ির প্রতিযোগিতা।

নথিভুক্ত বা মামলা হচ্ছে না অনেক অপরাধ
গত বছরের ৩১ আগস্ট বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি রাজধানীর দারুস-সালাম সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আহনাফ রহমান। এ ঘটনায় নিখোঁজ শিক্ষার্থীর মা দারুস-সালাম থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পর পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও থানায় কোনো মামলা করেনি পরিবার। এ ঘটনার পর ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর শাহ আলী থানা এলাকায় মেহেদী হাসান নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাত করে গুরুতর আহত করে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। দীর্ঘদিন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মেহেদীর বাবা রাফিউল ইসলাম হামলাকারীদের বিরুদ্ধে শাহ আলী থানায় হত্যাচেষ্টার মামলা করতে গেলেও কয়েক দিন ঘুরিয়ে পুলিশ মামলা নেয়নি। এ দুটিই নয়, এমন আরও অনেক বিষয়েই মামলা হয় না। নথিভুক্ত হয় না অপরাধ সংঘটিত হওয়ার প্রকৃত চিত্র। ফলে অনেক অপরাধই তালিকার বাইরে থেকে যায়। প্রতি বছর যেসব অপরাধ চিত্র পাওয়া যায়, এর বাইরেও অনেক অপরাধ সংঘটিত হয় রাজধানীতে।

রাজধানীতে নানা অপরাধের কারণ ও কমাতে করণীয়
রাজধানীতে নানা গোত্রের মানুষের বসবাস। পারস্পরিক সম্পর্কের ঘাটতি, নিম্নআয়, ভাসমান ও ছিন্নমূল মানুষের বসবাস যেমন রয়েছে আবার প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সাইবার অপরাধ থেকে শুরু করে নানাধরনের অপরাধ সংগঠিত হয় এলাকাভেদে। এছাড়া বিচারহীনতা বা বিচারপ্রক্রিয়ার দুর্বলতা, মানুষের কর্মহীনতা, আর্থসামাজিক বৈষম্যসহ নানা কারণে রাজধানীতে অপরাধ ঘটে বলে মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, কোথাও ঘনবসতিপূর্ণ, আবার কোনো এলাকায় নাগরিকদের পরস্পরের সম্পর্কে ঘাটতি, অপরাধীরা নগরীকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে নেওয়াসহ নানা কারণে রাজধানীতে এলাকাভেদে অপরাধের বৈচিত্র্যতা দেখা যায়। কোনো এলাকায় সম্পর্ককেন্দ্রিক অপরাধ যেমন একজনের সঙ্গে আরেকজনের মনোমালিন্য, ঝগড়া, মারামারি, পারিবারিক কলহ, বন্ধুত্বকে কেন্দ্র করে অপরাধ। আবার যেসব এলাকায় ঘনবসতি বেশি সেখানে চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণের ঘটনা বেশি।

তিনি বলেন, অপরাধ অনুযায়ী আইনের যথাযথ প্রয়োগ। নগরীর উপযুক্ত পরিবেশ, দায়িত্ববোধসম্পন্ন নাগরিকদের বসবাসের জন্য কৌশলী পরিকল্পনা নিয়ে এসব ঘটনা অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স (অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান) বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল কাদের মিয়া বলেন, সেসব এলাকায় সবধরনের মানুষের বিচরণ বেশি সেখানে অপরাধীরা ছোট অপরাধগুলো সহজেই করে ফেলে। আর খুন-অপহরণ বা বড় ঘটনাগুলো হয় সাধারণত নীরব এলাকায়। যাতে অপরাধীরা সহজে পার পেয়ে যেতে পারে। রাজধানীতে এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বিট পুলিশিং আরও বাড়ানো উচিত। সেইসঙ্গে মাদক, চোরাচালানসহ যেসব অপরাধে তরুণরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেসবের সাপ্লাই চেইন (সরবরাহ ব্যবস্থা) বন্ধ করতে হবে।

 







সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত

এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ