কেনা হচ্ছে ১০০ বৈদ্যুতিক দ্বিতল এসি বাস
|
দেশে প্রথম বারের মতো ১০০ বৈদ্যুতিক দ্বিতল এসি বাস কিনবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)। এই বাসগুলো কিনতে প্রকল্পের আওতায় ব্যয় হবে ১ হাজার ২৫২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। মোট ব্যয়ের মধ্যে সরকারি ব্যয় ২৫৬ কোটি ২৭ লাখ এবং ভারতীয় ঋণ ধরা হয়েছে ৯৯৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরতলিতে বাসগুলো চলাচল করার পরিকল্পনা রয়েছে। চলতি সময় থেকে ৩০ জুন ২০২৫ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। এর আগে ২০০২ সালে সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (সিডা) অর্থায়নে ৫০টি ভলভো বাস আমদানি করা হয়। বাসগুলোর একেকটির মূল্য এক কোটি তিন লাখ টাকা। অবহেলা ও অযত্নে ভলভো বাসগুলোর ঠাঁই হয়েছে ভাগাড়ে। নতুন আধুনিক বাসের অবস্থাও যেন ভলভো বাসের মতো না হয় সেই শঙ্কা প্রকাশ করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। ‘বিআরটিসির জন্য বৈদ্যুতিক দ্বিতল এসি বাস সংগ্রহ’ প্রকল্পের আওতায় এমন উদ্যোগ নেওয়া হবে। আন্তঃনগরের নির্ভরযোগ্য এবং আরামদায়ক গণপরিবহন সুবিধা বাড়ানো, আধুনিক প্রযুক্তিগত পরিবহন ব্যবস্থায় প্রবেশ করা, বিআরটিসি বহর থেকে পুরোনো বাস প্রতিস্থাপন করা; শহরে যানজট এবং পরিবেশ দূষণ কমানো ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। বিআরটিসি জানায়, পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের দ্রুত বৃদ্ধির সঙ্গে, অটোমোবাইল শিল্পসহ বেশ কয়েকটি শিল্পে উদ্ভাবনী সমাধান এবং প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ শহরগুলোতে বায়ুদূষণের একটি প্রাথমিক উৎস হলো যানবাহন নিষ্কাশন। বৈদ্যুতিক যানবাহনের উল্লেখযোগ্য সুবিধা হলো বাসগুলো দূষণ রোধে অবদান রাখে। বৈদ্যুতিক যানবাহন চালানোর সময় কোনো ধোঁয়া নির্গত হয় না। ফলে বায়ুদূষণও হয় না। বৈদ্যুতিক যানবাহন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কম এবং সর্বোপরি পরিবেশবান্ধব। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা হলো সবার জন্য ভালো এবং টেকসই ভবিষ্যতের জন্য একটি নীলনকশা হিসেবে পরিকল্পিত বৈশ্বিক লক্ষ্যগুলো আন্তঃসম্পর্কিত। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০১৫ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন করা হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ডিজেল বা সিএনজি বাসগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়ে যাবে। ২০৩৫ সালের পর অটোমোবাইল নির্মাতারা আর ডিজেল ইঞ্জিনের গাড়ি তৈরি করবে না। তাই এখনই বিআরটিসির বহরে বৈদ্যুতিক গাড়ি যুক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তা না হলে হঠাৎ করেই বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে। সে বিবেচনায় বিআরটিসি প্রথম পর্যায়ে ইন্ডিয়ান লাইন অব ক্রেডিটের অধীনে তার বহরে ১০০টি ইডি যুক্ত করার পরিকল্পনা ও বৈদ্যুতিক যানবাহন সম্পর্কিত অবকাঠামো যেমন বৈদ্যুতিক চার্জিং স্টেশন স্থাপন, এজাতীয় বাসের জন্য উপযুক্ত কাজের শেড নির্মাণ, দক্ষ জনবল তৈরি (টেকনিশিয়ান/ড্রাইভার ইত্যাদি), ওয়াশিং প্ল্যান্ট স্থাপন এবং প্রয়োজনীয় সুবিধাদি ও প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম প্রয়োজন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ইন্ডিয়ান লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) ঋণের আওতায় ১০০টি বৈদ্যুতিক দ্বিতল এসি বাস ও ১৫ শতাংশ যন্ত্রাংশ সংগ্রহের লক্ষ্যে প্রকল্পটি নেওয়া হচ্ছে। বিআরটিসি জানায়, শুধু একটি এসি বাস কিনতেই প্রস্তাবিত ব্যয় ৪৫৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ফলে প্রতিটি বাসের দাম পড়ে ৪ কোটি ৫৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। বাসগুলো পরিচালনার জন্য ৪৬০ জনের জন্য বৈদেশিক প্রশিক্ষণ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এছাড়া ২৫০ জনের স্থানীয় প্রশিক্ষণ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ কোটি টাকা। বাসগুলোর পার্টস কেনা বাবদ ৬৮ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। ১১ কেভি ব্রেকার, ১১ কেভি ক্যাবল, সাব-স্টেশন ও টার্মিনেশন কিটস বাব ২৭৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। চার্জার ইনকামিং অ্যান্ড আর্থিং ক্যাবলস অ্যান্ড ইটস টার্মিনেশন খাত বাবদ ১৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। বিআরটিসি’র চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরতলিতে চলাচলের জন্য ১০০টি আধুনিক বৈদ্যুতিক এসি বাস কেনা হবে। সব বাসই দ্বিতলবিশিষ্ট। আমরা মাত্র প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি।’ পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলেন, এর আগে সুইডেন থেকে আমদানি করা আধুনিক ডাবল ডেকার বাসগুলোর অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছিল ১৫ বছর। কিন্তু ৮ বছর না যেতেই সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পরিত্যক্ত হয়ে গেছে কোটি কোটি টাকায় কেনা বাসগুলো। সঠিক মেরামতের অভাবে অচল হয়ে পড়ে থাকা ভলভো বাসগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে গেছে। ভলভো বাসের নষ্ট যন্ত্রাংশ সময়মতো বদলানো হয়নি। সুইডিস মোটরস সন্তোষজনকভাবে বাস মেরামত করেনি। পরবর্তীসময়ে ছোটখাটো অনেক যন্ত্রাংশ নষ্ট হলে তা আর ঠিক করা হয়নি। ফলে পরে বাসগুলো ভাঙারি/// দরে বিক্রি করা হয়। বৈদ্যুতিক এসি বাস কেনার পরিকল্পনা ভালো। কিন্তু অবকাঠামো ও দক্ষ জনবল তৈরি না করে আধুনিক বাসগুলো কিনলে একই পরিণতি হবে। গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘আমরা এর আগে যত বাস কিনতে দেখেছি কোনো বাসই অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল পার করেনি। এতে সরকারের দায়বদ্ধতা নেই। সরকারের ফোকাস বাস কেনায়! এটা সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুঘলকিপনা। কারণ বাসগুলো কিনতে বড় ধরনের প্রকিউরমেন্ট হয়। অতীতের কোনো প্রকিউরমেন্টে সরকারের রিটার্ন হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, আজ হোক কাল হোক ইলেকট্রিক পরিবহন পদ্ধতিতে যেতে হবে। তার আগে অবকাঠামো ও দক্ষ জনবল জরুরি। বেসরকারি খাত এসব বাস কিনতে পারে। সরকার পরিবেশ তৈরি করবে। বেসরকারি খাতের বাস দীর্ঘ সময় ধরে চলে। কিন্তু সরকারি বাস বেশিদিন চলে না। আমি বলবো অবকাঠামো ও পলিসি সাপোর্ট করা। না হলে এসব বাসও বেশিদিন টিকবে না।
|