করমুক্ত আয়সীমায় আসতে পারে সুখবর
|
বছরখানেক ধরে বাড়তে থাকা দ্রব্যমূল্য আকাশ ছুঁয়েছে রোজা ও ঈদ কেন্দ্র করে। হাপিত্যেশ কাটছে না নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের। করোনা মহামারি থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সংকট বিশ্বব্যাপী দীর্ঘায়িত হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। এমন বাস্তবতায় আগামী বাজেটে অন্তত নিম্ন মধ্যবিত্তকে নিস্তার দিতে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর দাবি উঠেছে। এনবিআরও কিছুটা ইতিবাচক বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। মাসিক আয় ২৫ হাজার টাকার বেশি হলেই তাকে আয়কর দিতে হয়। কিন্তু বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বলছে, একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের তিন থেকে পাঁচজন সদস্য নিয়ে শহরে থাকতে গেলে ৩০ হাজার টাকায়ও সংকুলান হয় না। সেখানে তাকে আয়করের আওতায় আনা মানে অনেকটা ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ এর মতো। সাইকেলে করে মিরপুরের বিভিন্ন দোকানে কাপড়ের ব্যাগ বিক্রি করেন রূপনগরের বাসিন্দা নুরুল আমিন। মিরপুর-১২ নম্বরের একটা কারখানা থেকে ব্যাগ কিনে সেটা দোকানে প্রতি পিস ৫-১০ টাকা লাভে বিক্রি করেন। সপ্তাহের সাতদিনই সাত-আট ঘণ্টা কাজ করেন তিনি। এতে কোনো দিন তার ৮০০ তো কোনো দিন হাজার টাকা থাকে। আবার কোনো দিন বিক্রি কম হলে ২০০-৩০০ টাকা লাভ হয়। এভাবে মাসে ২৫ থেকে ২৮ হাজার টাকার আয় নুরুল আমিনের। তিন সন্তান, স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মিরপুরের একটা টিনশেড বাড়িতে। জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে অনেক হিসাব করে চলেন। আগে ঘন ঘন পৈতৃক ভিটা লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ গেলেও এখন তা কমিয়ে দিয়েছেন। তিন মেয়ের মধ্যে দুজন মাদরাসায় পড়ে। একজন ক্লাস ওয়ানে, আরেক জন ক্লাস ফোরে। তাদের পেছনে মাসে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা খরচ হয়। ছোট আরেক মেয়ে আছে তিন বছর বয়স। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে গলদঘর্ম হয়ে যেতে হয়। সব সময় এক আয় থাকে না, অনেক সময় দোকানদার মাল কেনেন বাকিতে। কেবল নুরুল আমিন নন, ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয়ের এমন নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ, যাদের বাড়তি আয়ের সুযোগ নেই তারা মহামারির পর থেকে মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে কঠিন যুদ্ধ করছেন। তার ওপর মাসিক আয় ২৫ হাজার টাকা ছাড়ালেই করের আওতায় আসতে হয়। কারণ বাৎসরিক তিন লাখ টাকা পর্যন্ত কর দিতে হয় না। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, মাছ ও মাংস ছাড়া রাজধানীতে চারজনের একটি পরিবারে প্রতি মাসে খাবারের পেছনেই খরচ হয় ২২ হাজার ৬৬৪ টাকা। ২৫ হজার টাকা আয়ের ওপর করের বোঝা তাদের জন্য অনেক ভারী। আগামী বাজেটে সেক্ষেত্রে করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা করা উচিত। এছাড়া বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা চার লাখ টাকা করার দাবি জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনসহ (এফবিসিসিআই) একাধিক সংগঠন। এসব সংগঠনের দাবি আমলে নিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বাড়তে পারে করমুক্ত আয়সীমা। সেটা সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে বলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, আগামী বছর নির্বাচনের বছর। তার আগে নিম্নবিত্ত মানুষের অর্থনৈতিকভাবে স্বস্তি ফেরাতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। তবে সবই নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের ওপর। রাজস্ব বোর্ডের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, সংগঠনগুলোর প্রস্তাব আমাদের কাছে রয়েছে। সেগুলো সামারাইজ করে আমরা প্রধানমন্ত্রীকে জানাবো। প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের পর তাকে অবহিত করা হবে, সেক্ষেত্রে আগামী মাসে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। চলতি অর্থবছরে করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা। তিন লাখের বেশি থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে পাঁচ শতাংশ কর রয়েছে। ১০ লাখের বেশি থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে ১০ শতাংশ, ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে ১৫ শতাংশ, ৫০ লাখ টাকা আয়ে ২০ শতাংশ এবং ৫০ লাখের বেশি টাকা আয়ে ২৫ শতাংশ কর দিতে হয়। নারী ও জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা। প্রতিবন্ধী ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে এই আয়সীমা যথাক্রমে সাড়ে ৪ লাখ ও ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। জানা যায়, মহামারির প্রভাব ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেওয়ায় অনেকের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় চলতি বাজেটেই করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিল ব্যবসায়ী ও অন্য সংগঠন। তবে তা বাজেটে অপরিবর্তিত রাখা হয়। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের কোনো কূল-কিনারা না হওয়ায় মূল্যস্ফীতির হার অত্যধিক বাড়তে থাকায় ওই দাবি আরও জোরালো হয়েছে। রাজস্ব বোর্ড সূত্র আরও জানায়, করজাল বাড়ানো ও করের আওতা বাড়ানোয় বেশি মনোযোগ দেওয়া হবে এবারের বাজেটে। করমুক্ত আয়সীমা বাড়ালে রাজস্ব কিছুটা কমবে, তবে অন্য খাত থেকে ঘাটতি পূরণে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে রাজস্ব বোর্ড। জানতে চাইলে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কোভিডের পর থেকে এই করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। আয়সীমা বাড়ানো গেলে সেটা অবশ্যই ভালো। এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তিনি বলেন, সরকারের রাজস্ব দরকার সেটাও মাথায় থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে একবারে বড় পরিমাণে আনার চেয়ে ধাপে ধাপে সেটা বাড়ানো গেলে তা ইতিবাচক হবে। এটা করা হলে মানুষের হাতে ডিসপোজেবল ইনকাম কিছুটা বাড়বে। করপোরেট ও অগোচরভূত খাত থেকে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে রাজস্ব বোর্ডের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, কর জাল বিস্তৃত করা ও করের আওতার বাইরে যে সব অর্থ রয়ে গেছে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। করপোরেট খাত বা ব্যক্তিখাতে এমন অনেক অর্থ রয়ে গেছে যেগুলো রিপোর্টেড না, ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্টে যেগুলোর রিপোর্ট হচ্ছে না সেগুলোকে কীভাবে ট্যাক্স স্ট্রাকচারে নিয়ে আসা যায়, ব্যাংকিং চ্যানেল কে এখানে ব্যবহার করে সেই উদ্যোগটা নেওয়া দরকার। এখানে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের সুযোগ আছে। |